মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :
স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত কক্সবাজারের উখিয়ার সন্তান শহীদ এটিএম জাফর আলমের ৫০ তম শাহাদাত বার্ষিকী আজ। ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ কালোরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ইকবাল হলে এই মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের অকুতোভয় সেনানী পাক হানাদার বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ করেন। নিজের জীবন তুচ্ছ করে সেই কালো রাতে পাক হানাদার বাহিনীর সম্মুখে দাঁড়িয়ে বীরদর্পে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে লাল সবুজের পতাকা উপহার দেয়ায় তিনি বেঁচে আছেন কক্সবাজারবাসীর হৃদয়ের মাঝে।
বর্তমানে বিশ্বব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক, সাবেক মন্ত্রীপরিষদ সচিব মোঃ শফিউল আলমের বড় ভাই স্বাধীনতা পুরুস্কার ২০১৯ প্রাপ্ত শহীদ এ.টি.এম জাফর আলম উখিয়া উপজেলার হলদিয়া পালং ইউনিয়নের রুমখা পালং গ্রামে জম্ম গ্রহন করেন। এ.টি.এম জাফর আলম সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে দুর্লভ এই চাকুরীতে নোয়াখালীর এসডিও হিসাবে নিয়োগপত্র পান। কিন্তু সিএসপি অফিসার হিসাবে যোগ দেয়ার আগে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রথম দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রাবাসে পাক হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ হন। অত্যন্ত মেধাবী শহীদ এ.টি.এম জাফর আলমের নামে কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের নামকরণ ও রামু উপজেলার খুনিয়াপালং ইউনিয়নের ধেছুয়া পালং এ শহীদ এ.টি.এম জাফর আলম মাল্টিপারপাস ইনষ্টিটিউট, কক্সসবাজার জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষের নামকরণ সহ আরো বেশ কিছু শিক্ষা ও কল্যানকর প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে।
এ.টি.এম জাফর আলমের জীবন :
টগবগে যুবক, বুক ভরা স্বপ্ন নিয়ে মায়ের আঁচল ছেড়ে পড়তে গিয়েছিলেন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। যে যুগে মায়েরা সন্তানদের আগলে রাখতেন নিজ চৌহর্দী সীমানায়, সেযুগে মমতাময়ী মায়ের স্নেহের পরশ বুলানো আদর ভালবাসার স্পর্শ পরিত্যাগ করে ঘর ছেড়ে বেরিয়েছিলেন যে যুবক, সে যুবকের মনের গভীরে অন্য দশজনের মত অব্যক্ত পুঞ্জিভূত স্বপ্নের সাথে মিশ্রিত ছিল হয়তো মধ্যবিত্ত একটা পরিবারের হাজারো স্বপ্ন। অসাধারণ মেধাবী সে যুবক শিক্ষাজীবনের সবক্ষেত্রে রেখেছিলেন মেধার স্বাক্ষর। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে স্বপ্ন পূরণের ক্ষেত্রও বেছে নিয়েছিলেন। তৎকালিন সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তান (সিএসপি) পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়ে নিয়োগ পেয়েছিলেন। কিন্তু বাধ সাধে নিয়তি! পাকবাহিনীর নির্মম বুলেট স্তম্ভিত করে দেয় সবকিছু। সম্ভাবনাময়ী যুবক লুটিয়ে পড়েন চিরচেনা সেই প্রিয় ক্যাম্পাসে। রক্তে রঞ্জিত হল ছাত্রাবাস। রঞ্জিত রক্ত হলের সিঁড়ি বেয়ে সবুজ ঘাসের বুকে হবু স্বাধীন বাংলাদেশের কল্পিত পতাকা এঁকে ঘুমিয়ে পড়ে যুবক। মায়ের গগনবিদারী আর্তনাদও ঘুম ভাঙ্গাতে পারেনি যে হতভাগ্য যুবকের, তিনি আমাদের গর্বের ধন শহীদ এ.টি.এম জাফর আলম। যিনি নিজের জীবন তুচ্ছ করে, কাপুরুষতা পরিহার করে হায়েনা রুপি পাকবাহিনীর সম্মুখে দাঁড়িয়ে বীরের বেশে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার ত্রিশ লক্ষ শহীদের একজন হয়ে বেঁচে আছেন আমাদের হৃদয়ে শ্রদ্ধা ও ভালবাসার আসনে। ১৯৭১সালে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম দিকের শহীদ এটিএম জাফর আলম ( মুক্তিযোদ্ধার আইডি নং- ০২০৬০৫০০৪১, গেজেট নং ৩৩১)। পুরো নাম আবু তাহের মোহাম্মদ জাফর আলম।
জন্ম ও পারিবারিক পরিচিতিঃ
কক্সবাজার জেলাধীন উখিয়া উপজেলার হলদিয়া পালং ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের রুমখাঁ পালং গ্রামের মাতবর পাড়ার মরহুম তমিম গোলাল মাতব্বরের ৭ ছেলের একজন মরহুম ছৈয়দ হোছন মাস্টার। উখিয়ার প্রথিতযশা আলেম মরহুম ছগির আহমদও তমিম গোলাল মাতব্বরের সুযোগ্য সন্তান। মরহুম তমিম গোলাল মাতব্বরের কতিপয় উত্তরসূরীদের বর্ণাঢ্য জীবনী দেখলেই অনুমান করা যায় তৎকালীন বৃটিশ ও পাকিস্তান আমলে এই পরিবারের বেশ যশ-খ্যাতি ছিল। সেই প্রসিদ্ধ পরিবারের যোগ্য উত্তরসূরী মরহুম ছৈয়দ হোছন মাস্টারের ঘরে ১৯৪৭ সালের ৫ মে জন্মগ্রহণ করেন শহীদ এ.টি.এম জাফর আলম। মাতার নাম মরহুমা আলমাছ খাতুন। মরহুম ছৈয়দ হোছন মাস্টার ও মরহুমা আলমাছ খাতুনের দম্পতির ৮ ছেলে ও ১ মেয়ের মধ্যে শহীদ এ.টি.এম জাফর আলম ছিলেন সবার বড়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান মন্ত্রীপরিষদ সচিব মোঃ শফিউল আলম ও উখওয়া উপজেলার হলদিয়া পালং ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ শাহ আলম মরহুম ছৈয়দ হোছন মাস্টারের সুযোগ্য সন্তান এবং শহীদ এ.টি.এম জাফর আলমের আপন সহোদর। শহীদ এ.টি.এম জাফর আলমের অন্যান্য ভাইয়েরা হলেন-মোঃ নুরুল আলম, মোঃ ফরিদুল আলম, ডাঃ শামশুল আলম, মোঃ সুরত আলম ও মোঃ জুহুর আলম। একমাত্র বোন হচ্ছেন-রাবেয়া বেগম, তাঁর স্বামী কামরুল ইসলাম হচ্ছেন-ইসলামি ব্যাংকের সহকারি ভাইস প্রেসিডেন্ট (এভিপি)। শহীদ এ.টি.এম জাফর আলমের রত্নগর্ভা মাতা আলমাস খাতুন ২০১৮ সালের ২৭ ডিসেম্বর ইন্তেকাল করেন।
শিক্ষাজীবন :
শহীদ এ.টি.এম জাফর আলম রুমখা সরকারি প্রাইমারী স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শেষে মহেশখালী আইল্যান্ড উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এস.এস.সি এবং চট্টগ্রাম কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে এইচ.এস.সি পাশ করে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের উদ্দ্যেশ্য ভর্তি হয়েছিলেন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগে। সেখান থেকে কৃতিত্বের সহিত উচ্চতর ডিগ্রী সম্পন্ন শেষে তৎকালীন সিএসপি পরীক্ষায় নিজের মেধা ও যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে নোয়াখালীর এসডিও হিসেবে নিয়োগও পেয়েছিলেন। তারআগে শহীদ এ.টি.এম জাফর আলম চট্টগ্রাম সরকারি বাণিজ্য কলেজে কিছুদিন অধ্যাপনাও করেন।
যেভাবে শহীদ হনঃ
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চে চাকরীর নিয়োগপত্র গ্রহণ করে স্বপ্ন পূরণের সোপানে পা রাখতে না রাখতেই পরেরদিন ২৫ মার্চ স্বাধীনতার পক্ষে ডাক পড়ে শেখ মুজিবর রহমানের। আর এতেই বেপরোয়া হয়ে উঠে রাক্ষুসে পাকিস্তানি বাহিনী।
পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপের দিকে এগোতে থাকলে জীবন রক্ষার তাগিদে হলের অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রী সহ শহীদ এ.টি.এম জাফর আলমের কাছের বন্ধুদের অনেকেই হল ছেড়ে চলে গেলেও কঠিন দেশপ্রেম তাঁর চলে যাওয়ার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। তাইতো বাড়িতে চলে যাওয়ার জন্য ব্যাগ গুছিয়েও সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে থেকে গেলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলে। ২৫ মার্চ শেষ রাতে দেশের অন্যান্য স্থানের মত পাক হানাদার বাহিনীর তান্ডবে পরিনত হয় শহীদ জাফরের প্রিয় শিক্ষাঙ্গন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল সহ কতিপয় ছাত্রাবাস। রাইফেল হাতে দেশপ্রেমের তীব্র স্পৃহা নিয়ে পাক হানাদারদের প্রতিহত করার সমর যুদ্ধে লড়তে লড়তে শহীদ হয়ে রচনা করেন এক বীরত্বকাব্য।
শহীদ এ.টি.এম শহীদ জাফর আলমই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি মরনোত্তর কক্সবাজার সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মানজনক স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়ে পুরো কক্সবাজার জেলাবাসীকে মর্যাদাবান করেছেন।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।